কারুচিত্রের খোঁজে: কমলকুমার ও বঙ্গীয় চিত্রধারণা / সংস্কৃতি চট্টোপাধ্যায়

কারুচিত্রের খোঁজে: কমলকুমার ও বঙ্গীয় চিত্রধারণা

সংস্কৃতি চট্টোপাধ্যায়

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তাঁর নোবেলগ্রহণ-বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিলেন, ‘আমাদের বাস্তবতার ব্যাখ্যা যদি হয় এমন কিছু ছাঁচে, যা আমাদের নিজস্ব নয়, তবে তা কেবল আমাদের আরও অজানা, আরও বদ্ধ, আরও একা করে তোলে।’ এরকম এক সমস্যার মধ্যে দাঁড়িয়ে, এই প্রবন্ধটি মনোযোগ দিতে চাইবে, ‘আদার’ ও ‘সাবঅল্টার্ন’— এই দু-টি চির-স্বরহীন অস্তিত্বের প্রতি, যাদের বিভিন্ন স্তরে হয়ে চলা মূলত এক ঊনতা, বিহীনতা, অভাবের রঙে রঞ্জিত উপস্থাপনা এই স্বরহীনতাকেই আন্ডারলাইন্ড বা নিম্নরেখচিহ্নিত করে চলে।
‘ইমেজ’ ধারণার মাধ্যমে, (এই ‘ইমেজ’ চিত্র বা ছবি নয়, বরং এক সহজাত মানবিক প্রবৃত্তি যার ছাপ পাওয়া যায় শিল্পে ও সাহিত্যের নানা স্তরে) এই প্রবন্ধটি জ্ঞান-সৃষ্টির এক সমান্তরাল প্রবাহ অধ্যয়ন করবে। এক দৃশ্যবহুল সংস্কৃতিতে বসবাস করা সত্ত্বেও, এই চাক্ষুষ জগতের মূল (যা আমাদের সংস্কৃতির বোধকে অনেকাংশে অবহিত করে)— ‘ইমেজ’— সময়, চেতনা ও ধারণার সঙ্গে পরিবর্তনসাপেক্ষ নয়। ভিসুয়াল আর্টকে একটি সমান্তরাল জ্ঞান-প্রবাহক ব্যবস্থা হিসাবে যদি ভাবা সম্ভব হয়, তবে ‘ইমেজ’ কি এই দুইয়ের মধ্যে কথোপকথনের পথ প্রশস্ত করতে পারে যা ঔপনিবেশিকতা এবং সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসজাত ‘সাবঅল্টার্ন’ অবস্থানকে এক নতুন আলোয় দেখতে পারে?

ঔপন্যাসিক কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাস অন্তর্জলী যাত্রা, চলচ্চিত্রনির্মাতা গৌতম ঘোষের এই উপন্যাসটির চলচ্চিত্র রূপান্তর এবং গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের ১৯৯২ সালে লেখা প্রবন্ধ ‘অ্যাক্টিং বিটস/আইডেন্টিটি টক’ (যেখানে তিনি উপন্যাস এবং চলচ্চিত্রটিকে একভাবে পাঠ করেছেন)-এর একটি মেটা-ত্রিভুজ, যেখানে একটি টেক্সট অন্যটির একপ্রকার অনুবাদ তৈরি করছে অন্য মাধ্যমে, এই প্রবন্ধের কেস স্টাডি হিসেবে উপস্থিত করা হবে। এইসব ‘টেক্সট’-এর প্রত্যেকটি বিভিন্ন উপায়ে ‘ইমেজ’-এর ধারণাকে তাদের নিজেদের স্থান থেকে অন্বেষণ করে। সেই খোঁজে ‘ইমেজ’-এর প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে তা আইডেন্টিটিকে আকারদান করছে তার একটি ধারণা প্রস্তুত করাই আমাদের লক্ষ্য।

এখন সাবঅল্টার্ন, ডিকলোনিয়ালিটি ও চিত্রধারণা– এই ত্রয়ীর মধ্যে এক কল্প-অন্তর্জাল তৈরির আগে এই টার্ম তিনটিকে একটু নাড়াচাড়া করে নেয়া যাক। প্রথমে সাবঅল্টার্ন দিয়ে শুরু করা যাক। এই শব্দটির উৎস বেশ নাটকীয়। সাবঅল্টার্ন শুরুতে ছিল কেবল একটি বিশেষ সামরিক পদবি। আন্তোনিও গ্রামশি জেলে থাকাকালীন সেন্সরশিপ থেকে নিজের লেখাকে বাঁচিয়ে বাইরে পাঠাবার জন্য ‘প্রোলেতারিয়েত’ শব্দের এক গোপন প্রতিশব্দ হিসেবে প্রথম ব্যবহার করেন ‘সাবঅল্টার্ন’ শব্দটিকে। পরিস্থিতিগত চাপের সামনে উদ্ভূত এই টার্মটির কোনো তথাকথিত সংজ্ঞাবদ্ধতা না থাকায়, এটি এক অদ্ভুত প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব লাভ করেছে যার মাধ্যমে বহু সামাজিক ‘আইডেন্টিটি’ এবং সংগ্রাম (যারা কোনো বিশেষ শ্রেণিবিশ্লেষণের আওতায় পড়ে না), নিজেদের ব্যক্ত করতে পারে। পোস্টকলোনিয়াল বা উত্তর-ঔপনিবেশিক বিশেষজ্ঞদের হাতে এই টার্মটির শুধু সংজ্ঞাপ্রাপ্তি নয়, একপ্রকার প্রজ্ঞাপ্রাপ্তিও ঘটে। এক সুসংগঠিত রাজনৈতিক পরিচয়ের অভাব, যা গ্রামশি-র ব্যবহারে ছিল, সেখান থেকে তার প্রসার ঘটে এক বহুধাবিভক্ত সমাজের নানা প্রত্যন্ত কোণের মানুষদের এক বিশেষ আইডেন্টিটিতে। (স্টিফেন, ৯৬-৯৭ এবং কুইন xiii-xiv)
ডিকলোনিয়ালিটি তত্ত্ব গত কয়েক দশকে, উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজ, রাজনীতি ও শিক্ষাকে কীভাবে ঔপনিবেশিকতার প্রলম্বিত প্রভাব থেকে আলাদা করা যায়, সে-বিষয়ে আন্তর্জাতিক অধ্যয়নজগৎকে এক নতুন পথ দেখিয়েছে। এর মূল তত্ত্ব এবং যেখানে এটি উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্ব (পোস্টকলোনিয়াল থিয়োরি) থেকে আলাদা হয়ে যায়, সেটি হলো, আমাদের আধুনিকতা (মডার্নিটি)-র সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত কলোনিয়ালিটি (এই বিশেষ শব্দটি ঔপনিবেশিকতা থেকে কিছুটা আলাদা, কাজেই এর কোনো বাংলা পরিভাষার উল্লেখ থেকে বিরতই থাকা গেল) এবং তার সমস্ত হিংস্রতা ও বর্বরতা। কাজেই আধুনিকতার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে কলোনিয়ালিটির বীজ এবং আধুনিকতার কোনো অগ্রগতিই এই ঋণাত্মক দিকটিকে অস্বীকার করতে পারে না। কাজেই ডিকলোনিয়াল (এর কোনো জুতসই পরিভাষা জানা নেই আমার) কোনো সম্ভাবনা খুঁজতে হলে আমাদের তা খুঁজতে হবে সম্পূর্ণ নতুন তত্ত্ব ও চিন্তার প্রস্তাবনায়, আমাদের আধুনিকতার মাধ্যমে প্রাপ্ত কোনো ধারণায় নয়।
ডিকলোনিয়ালিটির নানা গুরুত্বপূর্ণ অবদানের মধ্যে যেটি আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে, তা হলো থিয়োরি অব লিসেনিং বা শ্রবণতত্ত্ব (ভাজ়কুয়েজ়, ২০১৭, ২০১৮-২০১৯)। প্রখ্যাত ডিকলোনিয়াল চিন্তাবিদ রোলান্ডো ভাজ়কুয়েজ়-এর মতে, ডিকলোনিয়ালিটির মূল নান্দনিক সম্ভাবনা রয়েছে নিজেদের শুনতে শেখানোর মধ্যে। যে মানুষদের, যে গোষ্ঠীদের সম্পূর্ণ অবলুপ্তিকরণ ঘটেছে ঔপনিবেশিক গণহত্যা এবং অন্যান্য হিংস্রতা (জেনোসাইডাল ভায়োলেন্স)-র মাধ্যমে, সেই ঐতিহাসিকভাবে নীরব ভাষ্য শোনার জন্য আমরা কীভাবে নিজেদের তৈরি করতে পারি, এই তত্ত্ব সেকথাই বলে। কিন্তু যেখানে এই ধরনের প্রচেষ্টা ঘটেছে অতীতকে সম্পূর্ণভাবে অবলুপ্ত করার, তা একইসঙ্গে ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্ককেও বিচ্ছিন্ন করে। এই নীরবতার মধ্য দিয়ে কাজ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে এবং এখানেই ভাজ়কুয়েজ় ডিকলোনিয়ালিটির সীমা চিহ্নিত করেন। সুতরাং, এখানে ‘শোনা’র কাজটি অতীতে যা হারিয়ে গেছে তা এই বর্তমানে ফিরিয়ে দেওয়ার উপায় হয়ে ওঠে। এটি সেই স্মৃতিগুলি পুনরুদ্ধার করার একটি উপায় হয়ে ওঠে যা নীরব হয়ে গেছে এবং আমরা যে-বিশ্বের ধারণা তৈরি করি নিজেদের জন্য সেখানে আর স্থান নেয় না। সুতরাং, ‘শ্রবণ’ আর একটি নিষ্ক্রিয় কাজ নয়, বরং নীরবতার মূর্ত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জ্ঞানসৃষ্টির গঠনে অংশ নেওয়ার সক্রিয় আমন্ত্রণ। এরপর ভাজ়কুয়েজ় শ্রবণ-চিন্তার ত্রিভুজের তৃতীয় কোণের পরিচয় দেন। শোনার ক্রিয়ায় চিন্তাভাবনার অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমেই বহুবিধ কণ্ঠস্বর বিদ্যমান হতে পারে। এইভাবে তিনি কথোপকথনের শক্তির ওপর জোর দেন। এমন এক কথোপকথন যা কথিত, চিন্তিত এবং যা শোনা হয়েছে এবং হবে।
এবার যদি চিত্রধারণার প্রসঙ্গে আসি, তবে এটা বলা জরুরি যে এখানে ইমেজ বলতে কেবল দৃশ্যশ্রাব্য ছবির কথা বলা হচ্ছে না। বরং ভাবা হচ্ছে এক অন্তর্নিহিত প্রবৃত্তির কথা যা মানুষের প্রজাতিগত স্মৃতিতে বিদ্যমান। বিশিষ্ট দার্শনিক জিল দ্যলুজ় বলেন যে একটি ‘চিত্র=ফ্লোয়িং ম্যাটার (প্রবহমাণ বস্তু)’ (দ্যল্যজ়, ১৯৮৬) এবং যেহেতু সব কিছুই প্রবহমাণ বস্তু, তাই একটি চিত্র একটি বিশ্ব-খণ্ড, একটি মহাজাগতিক-খণ্ড, একটি মহাবিশ্ব-খণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ধারণার মাধ্যমে ‘ইমেজ’-এর একটি নিজস্ব সত্তা তৈরি হয়। ইমেজ কেবলমাত্র একটি উৎপাদিত বস্তু নয়; এমনকী ইমেজ অভিব্যক্ত হওয়ারও অপেক্ষা রাখে না। ইমেজ, যার বিদ্যমানতা কোনো প্রকাশের আকাঙ্ক্ষা রাখে না, কিন্তু মানুষের সহজাত গুণগুলির একটি হয়ে অস্তিমান থাকে, আমরা সেই চিত্রধারণার কথা আলোচনা করব।
কমলকুমার তথাকথিত সাবঅল্টার্ন সাহিত্যের মধ্যে পড়েন কি না সে-বিষয়ে মতভেদ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফারাক তৈরি করা প্রয়োজন– আখ্যানের গঠন ও আখ্যানের বিষয়বস্তু (ন্যারেটিভ ফর্ম ও ন্যারেটিভ কনটেন্ট)। অন্তর্জলী যাত্রা (মজুমদার ১৯৬৯, ২০১১), যা এই লেখার মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে, যদি তাকে আমাদের উদাহরণ হিসাবে নেয়া যায়, তবে সেখানে সাবঅল্টার্ন চরিত্র এবং তাকে নিয়ে বিশেষ কনসার্ন প্রধানত বৈজু চাঁড়ালকে ঘিরেই গড়ে উঠবে। কিন্তু তা দিয়ে সমগ্র কাহিনিকে বিচার করলে আমরা হয়তো অনেক কিছুই দেখতে পাব না। কাজেই কাহিনির বিষয়বস্তু কী তা দিয়ে নয়, এখানে উপন্যাসের পরিমিতির ধারণার ক্ষেত্রে তার গঠনশৈলীকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।
কমলকুমার এক অসম্ভব কৃতিত্বের শিখর অর্জন করেছেন তাঁর লেখার মাধ্যমে। প্রায় আইকনিক স্তরের শিল্পী কমলকুমার মজুমদারের বহুমুখী প্রতিভার আধার কেবল সাহিত্য নয়, চিত্রাঙ্কন, স্কেচ, কাঠে খোদিত কারুকলা বা উডকাট এমনকী বাদ্যযন্ত্রশিল্পও বটে। মূলত সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর অন্যতম অবদান হলো ইউরোপীয় রেনেসাঁ পরিপ্রেক্ষিতের (পার্সপেক্টিভ) বাইরে এক অন্যরকম সম্ভাবনার পরিচয় দেওয়া। ছবির ধারণাকে ইউরোপীয় রেনেসাঁ পরিপ্রেক্ষিত থেকে মুক্তির পথ তিনি খুঁজে পেয়েছেন নানা দেশীয় কারুশিল্প থেকে। এই কারুশিল্পের শিল্পীরা বহু শতকের অধ্যবসায়ে যে সৌন্দর্যবোধ তাদের কাজের, জীবনের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখে এসেছেন, কমলকুমার সেই নিরবচ্ছিন্ন বোধ, যা হয়তো নানা কারুশিল্পের চর্চা থেকে উদ্ভূত, তাকে বহন করেছেন নিজের লেখায়। কমলকুমারের মতে, ‘সৌন্দর্য শব্দটার তখন বর্ত্তমানতা যখন জীবনটা– দৈনন্দিন সবকিছু সুষ্ঠুভাবে চলিতেছে– মানে জীবন সম্পর্কে জ্ঞান আছে।’ কারুশিল্পগত চিত্রধারণার মাধ্যমে, সমাজের মূল স্রোতের বাইরের প্রায় অনাদৃত অথচ সমান্তরাল কিছু চর্চাকে সাহিত্যের ‘লিখিত ইমেজ’-এর স্তরে কমলকুমার নিয়ে এসেছেন, কমলকুমার সাবঅল্টার্ন বোধ নিয়ে এমন কিছু কাজ করে গেছেন যা আমাদের মূল ধারণাপ্রবাহের বাইরেই থেকে গেছে।
এখানে বলা প্রয়োজন যে, কারুশিল্প বলতে কেবল এক বিশেষ, সুনির্দিষ্ট অনুশীলনের কথা বলা হচ্ছে না। পামেলা স্মিথ উল্লেখ করেছেন: ‘পণ্ডিত বিশেষজ্ঞরা. . . বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা প্রস্তুত করেন, কারিগররা সেই বাস্তবতাকে দেখে থাকেন বস্তু ও উপাদানের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত হিসাবে।’ (স্মিথ ২০০৪) একটি সমষ্টিগত, বৃহৎভাবে রেনেসাঁ-প্ররোচিত স্মৃতিভ্রংশতার মাধ্যমে, কারুশিল্পের প্রাক্‌-শিল্পবিপ্লব ভূমিকা (শব্দ নয়, কাজের মাধ্যমে জ্ঞানসৃষ্টির প্রচেষ্টা) আমরা প্রায় ভুলেছি। কারুশিল্প, একটি পদ্ধতি হিসাবে, স্থান-কাল-প্রকৃতি– এই ত্রয়ীর কেন্দ্রে জীবনকে মূর্তরূপে (এমবডিড) স্থাপন করে। হাইডেগার-এর মতো দার্শনিকরা উল্লেখ করেছেন কীভাবে রেনেসাঁর ফলস্বরূপ প্রাথমিক জ্ঞানসৃষ্টি প্রক্রিয়া হিসাবে ‘দেখা’-র ভূমিকা এক অন্যতম উচ্চতায় পৌঁছেছে। দৃশ্যজগতের এই সুবিশাল ক্ষেত্রে আধুনিকতার নানা দিক সুস্থাপিত হয়েছে। আধুনিকতা বা মডার্নিটির নানা দিকগুলির মধ্যে যেগুলি সবচেয়ে সুস্পষ্টরূপে নিহিত রয়েছে আমাদের ‘দেখার’ মধ্যে, সেগুলি হলো– যৌক্তিকতা, বিমূর্ততা, বস্তুর ধারণাকে ফ্রেমের চারকোনা কাঠামোর মাধ্যমে দেখা, বাস্তববাদ, রক্ষণাত্মক অনুকৃতি বা মাইমেসিস, প্রসঙ্গ বা কনটেক্সটমুক্ত মান (ভ্যালু)-এর ধারণা ইত্যাদি।
ধীরে ধীরে দৃশ্যমানতা, কারুচিন্তার স্পর্শপ্রবণতাকে অস্বীকার করে এক নতুন ‘দেখা’ বা দৃশ্যনির্ভর মানদণ্ড তৈরি করে। দৃশ্যমানতার প্রতি এই প্রায় ফেটিশরূপী আকাঙ্ক্ষাকে ইতালিতে প্রথম চিত্রকলায় একক-পয়েন্ট দৃষ্টিকোণ আবিষ্কারের সাথে যুক্ত করা যেতে পারে, যা রেনেসাঁ দৃষ্টিকোণ (পারস্পেকটিভ) নামে পরিচিত। কার্যকারণ সম্পর্কের মাধ্যমে দৃশ্যমানতার যুক্তি সৃষ্টি করার যে উপায়গুলি গ্রহণ করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো– সুনির্দিষ্ট জ্যামিতিক উপায়ে গভীরতার বিভ্রম (ইল্যুশন অব ডেপ্‌থ) তৈরি করা, আলো-ছায়ার বাস্তবসম্মত সম্পর্ক, চিত্রের অগ্রভাগ, মধ্য-স্থল, পটভূমি– এই তিনের মধ্যে যৌক্তিক সম্পর্ক স্থাপন, দর্শক এবং শিল্পের মাঝে ফ্রেম-দ্বারা তৈরি করা বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি। এগুলি একত্রিতভাবে শিল্পচর্চা সম্পর্কে প্লেটোনিক ধারণাকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে একটি বড়ো ভূমিকা পালন করে। এখানে প্লেটোর সেই বিশেষ মতবাদের কথা উল্লেখ্য, যেখানে তিনি মনে করেন যে সংগীতজ্ঞেরা খুব উঁচু দরের শিল্পী নন, কারণ তারা প্রতিবার বাদ্যযন্ত্রকে সুরে আনার জন্য যন্ত্র এবং শ্রোতা উভয়কেই যথেষ্ট কষ্ট দেন, কিন্তু সঠিক সুর পেতে বিশুদ্ধ গাণিতিক উপায় ব্যবহার করেন না। প্লেটো উদ্দেশ্যমূলক অ্যালগরিদমের পক্ষপাতিত্বে সুরে ‘পৌঁছোনো’র গভীর জ্ঞানীয় পদ্ধতিকে অবমূল্যায়ন করছিলেন। কাজেই, সেই একই গাণিতিক নিয়মের তারে বাঁধা ইউরোপীয় রেনেসাঁ পদ্ধতিও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার মাধ্যমে সৃষ্টিতে ‘পৌঁছোনো’র ধারণাকে উপেক্ষা করে বাস্তবতার এক সীমিত চর্চা শুরু করে (গাঙ্গুলী ২০১১)।
এবার কমলকুমারের কাজের কিছু বিশেষ ধারার সঙ্গে পরিচিত হওয়া প্রয়োজন, যার মাধ্যমে তিনি ইউরোপীয় রেনেসাঁ পরিপ্রেক্ষিত থেকে ছবির ধারণাকে আলাদা করেছেন। প্রচলিত উপন্যাসের কাঠামোর মধ্যে ইউরোপীয় রেনেসাঁ দৃষ্টিকোণের প্রভাব আখ্যান অন্তর্বর্তী গঠনে পাওয়া যায়। কমলকুমার তাঁর উপন্যাসজীবনে এই দৃষ্টিকোণ থেকে ধীরে ধীরে অপসরণ করেন। অন্তর্জলী যাত্রা থেকে সুহাসিনীর পমেটম অবধি এ যাত্রা ক্রমান্বয়িক। অন্তর্জলী যাত্রা-তেই দেখা যায় কমলকুমারীয় ভাষা এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়া শুরু করেছে। এ ভাষা চলিত নয়, সাধুও নয়। পড়ার মাধ্যমে উপন্যাসের বোধগম্য হওয়া– কার্যকারণ সম্পর্কযুক্ত একরেখ যৌক্তিকতা (লিনিয়ার লজিক) আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ইউরোপীয় রেনেসাঁ পদ্ধতিকে। এই একরেখ যুক্তিকে খণ্ডন করে সিগনিফায়ার ও সিগনিফায়েড-এর মধ্যবর্তী সম্পর্ককে পরিবর্তন করেন কমলকুমার। বাক্যের অন্তর্বর্তী গভর্নেন্সকে (বাক্য গঠনের মধ্যে এক স্থানকের অন্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা) তাঁর সীমা অবধি নিয়ে গিয়ে এবং তাঁর মাধ্যমে বাক্যের গঠনকাঠামো বা সিনট্যাক্সকে প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন কমলকুমার। উপন্যাসটির দুর্বোধ্যতা এর উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য এর বোধগম্যতাকে সহজ ও সুস্পষ্ট না হতে দেওয়া। ভাষা সাবলীল, তবু আমাদের চেনা বোধবন্ধ (ইন্টেলিজিবল ফ্রেজ়)-এর মধ্যে নয়।
আমরা যখন একটি বাক্য পাঠ করি, তখন বাক্যটির অর্থ কিছুটা অনুমিত হয় আমাদের চেনা পাঠের উপর নির্ভর করে। আমাদের মস্তিষ্ক যখন একটি শব্দ গ্রহণ করে, তখন তাঁর আশেপাশের বেশ কিছু সমধর্মী, সহগামী শব্দকে অনুমান করে নিয়ে আমরা একটি ছবি পড়ি। কিন্তু সে সম্ভাবনা কমলকুমারের লেখায় অসম্ভব না হলেও বিরল। আমাদের ‘দেখা’র মাধ্যমে বোধগম্যতার প্রবাহ এখানে প্রশ্নচিহ্নের মুখে। কাজেই এই বিচ্ছিন্ন প্রভাবে আমাদের মনোযোগ দিতে হয় প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি অভিব্যক্তিতে। পড়া এখন আর নিরবচ্ছিন্ন জ্ঞানের প্রক্রিয়া নয়, বরং, এখন তা একটি ধীর, একাগ্র, নিবিষ্ট, ক্রমশ অগ্রগতির প্রক্রিয়া। আখ্যান এবং আখ্যানের গঠনরূপ উভয়েই পাঠের অংশ হয়ে ওঠে।
এতদ্‌সত্ত্বেও, অন্তর্জলী যাত্রা-য় উপন্যাসের ঐতিহ্যের কিছু উপাদান পাওয়া যায়। চরিত্রের বিকাশ, স্থাপন, পরিবেশ নির্ধারণ, পটভূমিকায় প্রস্তাবনা, দ্বন্দ্ব আখ্যানের শীর্ষবিন্দু (ক্লাইম্যাক্স), ও সমাধান (রেসোলিউশন)– সমস্তই এই উপন্যাসে উপস্থিত। আমরা যখন সুহাসিনীর পমেটম (মজুমদার ২০১১)-এ পৌঁছোই, তখন কমলকুমার এর প্রত্যেকটিকেই সংপ্রশ্ন করছেন। এমনকী বাক্যের পর বাক্য স্থাপন করে লেখার ধরনকেই তিনি চ্যালেঞ্জ করছেন। সুহাসিনীর পমেটম লিখিত মাত্র একটি অসমাপ্ত বাক্যে– যা বাহাত্তর পৃষ্ঠাজুড়ে পরিব্যাপ্ত। সুহাসিনীর পমেটম এই লেখার প্রত্যক্ষ পরিধির মধ্যে না থাকলেও তা লেখকের নিজস্ব বিস্তৃতির পরিচয় দেয়।
উপরোক্ত বাক্যগঠনের (সিনট্যাক্স) অন্তর্বর্তী বিচ্ছেদসাধনের জন্য কমলকুমার বেশ কিছু বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এখানে এই পদ্ধতিগুলির একটি সূচি উদাহরণসহ তৈরি করা যেতে পারে। সূচিটি অবশ্যই সামগ্রিক নয়, বা কমলকুমারের লেখকসত্তার সমগ্র পরিচয় দেওয়ার চেষ্টাও না। এগুলি কেবল তাঁর লেখায় বার বার ফিরে আসা কিছু মোটিফমাত্র।
এই সূত্রে অম্তর্জলী যাত্রা-র একটি সংক্ষিপ্ত সারাংশ তুলে ধরাটা জরুরি। গঙ্গার নির্জন তীরে বয়স্ক সীতারামকে আনা হয় তাঁর শেষ দিনগুলি অতিবাহিত করার উদ্দেশ্যে, যেখানে পবিত্র গঙ্গাজল তাঁর পা স্পর্শ করে তাঁকে পাপমুক্ত করে স্বর্গের পথ প্রশস্ত করে। তিনি এখানে যুবতী যশোবতীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সমাজশিরোমণিদের মতানুযায়ী সীতারামের মৃত্যুতে যশোবতীর সতী হওয়ার কথা। চণ্ডাল বৈজুনাথ, যে মানুষের নশ্বর দেহাবশেষের অবসানে শেষ সহায়তা করে এবং তবুও সামাজিক উত্তরাধিকারের শেষাংশে যার স্থান, সে এই উপন্যাসের তৃতীয় বিশিষ্ট চরিত্র। নির্জন গঙ্গাতীরে এই তিনটি চরিত্রের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক এবং তাদের নিজেদের এক বিকাশ উপন্যাসে ফুটে ওঠে।
এই উপলক্ষ্যে এটা মানে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে কমলকুমার যদিও স্বাধীনতার অন্তত দশক দুই পরে এই উপন্যাসটি লিখছেন, পটভূমিকা অনুযায়ী লেখাটি এক বিশেষ ঔপনিবেশিক সময়ের চিহ্ন তুলে ধরে। যদিও সতীপ্রথার ইতিহাস বহুশতাব্দীপ্রাচীন, তবু ঔপনিবেশিক বাংলায় এর প্রভাব এক ধরনের রাজনৈতিক সামাজিক রূপ নিয়েছিল। কাজেই এই বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে কমলকুমারের লেখকসত্তার এক অন্য দিকের পরিচয় পাওয়া যেতে পারে। একদিকে সতীপ্রথার প্রাচীনত্ব এবং দৈবী-মানবী এই দুইয়ের মাঝের এক অদ্ভুত অবস্থান তাঁকে এক মানসিক-দূরবর্তিতার দিকে নিয়ে যায়, অন্যদিকে ঔপনিবেশিক সময়ের বিশেষ সামাজিক অবনমনের এক উদাহরণ হিসেবে এটি আমাদের পরিচিতির মধ্যেই অবস্থান করে। কাজেই, এই নির্বাচনের মাধ্যমে ঔপনিবেশিকতার চেনা সময়ের পটভূমিকায় কমলকুমার আমাদের নিয়ে যান এক অচেনা অনুভূতির জগতে।
ইউরোপীয় রেনেসাঁ পারস্পেকটিভ-এর বাইরে আখ্যান বর্ণনার যে রীতি প্রথম চোখে পড়ে, তা হলো বাক্যের আনুভূমিক প্রবাহকে ত্যাগ করে এমন এক কাঠামো তৈরি করা যেখানে বাক্যের অংশের একের ওপর অন্যে স্তূপাকারে জমা হয়ে এক উল্লম্বিত গঠন তৈরি করে। উদাহরণরূপে আমরা উপন্যাসের একটি অংশ এখানে তুলে আনতে চাইব।
সীতারাম অতীব প্রাচীন হইয়াছেন; অধুনা খড়ের বিছানায় শায়িত; তিনি, যেমত বা স্থিতপ্রজ্ঞ, সমাধিস্থ যোগীসদৃশ, কেবল মাত্র নিষ্পলক চক্ষুর্দ্বয় মহাকাশে নিবদ্ধ, স্থির; তিলেক চাঞ্চল্য নাই, প্রকৃতি নাই– ক্রমাগতই বাঙ্‌ময়ী গঙ্গার জলছলাৎ তাঁহার বিশীর্ণ পদদ্বয়ে লাগিতেছিল। (অন্তর্জলী যাত্রা, পৃ ৫)
এখানে লক্ষ করা যায় যে বাক্যটি কেবল একরেখ নয়। অর্ধযতিচিহ্ন বা সেমিকোলন দ্বারা বিভাজিত অংশের একের পর অন্য হিসাবে অর্থ তৈরি না করে, একসঙ্গে একের উপর অন্যে দাঁড়িয়ে একটি ছবির সামগ্রিকতা তৈরি করে। অন্যভাবে বলতে গেলে, “বয়স্ক সীতারাম আপাতত শায়িত”-র বাইরে প্রতিটি অংশের সঙ্গে আমরা আসলে নতুন তথ্য লাভ করি না। অর্থাৎ সীতারাম শায়িত, তার আশেপাশে কে বা কারা রয়েছে, সে কোথায় আছে, সে কী করছে– এখানে বাক্যের চলন এই জাতীয় প্রায় গতানুগতিক নয়। আমরা যা পাই, তা আসলে সীতারামের শায়িত অবস্থাকেই নিম্নরেখচিহ্নিত করে চলে। আমরা ক্রমশ বাক্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে থাকি। শায়িত সীতারাম কেবল মূর্ত হয়ে ওঠে না, আমাদের এক বিশেষ মানসিক অবস্থায় নিয়ে যায়। এই অভ্যন্তরীণ চলন তৈরি হচ্ছে আসলে বাক্যের এক অংশের ওপর অন্যের স্থাপনার মাধ্যমে।
এবার নীচের এইসব বাক্যাংশগুলিকে একটু কাছ থেকে দেখা যাক:
“সীতারাম অতীব প্রাচীন হইয়াছেন;”– তথ্যের প্রথম উপাদান পাওয়া যাচ্ছে এই বাক্যাংশটিতে। একটি চরিত্রের উপস্থাপনা এবং একটি সংক্ষিপ্ত ঘটনার (সীতারাম বয়স্ক হয়েছেন) বর্ণনা।
“অধুনা খড়ের বিছানায় শায়িত;”– একটি ‘বিশেষণ চিত্র’ বলা যেতে পারে একে। পূর্ববর্তী বিবৃতিটিকে সবিশেষ এবং প্রাসঙ্গিক করা ও একপ্রকার পূর্ণতা প্রদান করা এই বাক্যাংশটির মূল উদ্দেশ্য। আমরা এখনও চিত্রগুলির মাধ্যমে একটি দ্বি-মাত্রিক স্থান তৈরি করার জায়গায় রয়েছি।
“তিনি, যেমন বা স্থিতপ্রজ্ঞ,”– আরেকটি বিশেষণ চিত্র, কিন্তু এইসময় এটি চরিত্রের বিশেষণ, স্থানের নয়। একটি স্পষ্ট স্থানিক প্রেক্ষাপট তৈরি করা থেকে প্রথম পদক্ষেপটি (উপরোক্ত বাক্যাংশদ্বয়) নেওয়া হয়েছিল। এই অংশটি পূর্ববর্তী বাক্যাংশের প্রতিতুলনায় সামান্য কিছু তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ‘দেখা’র একরেখ সম্ভাবনাকে স্থানচ্যুত করার চেষ্টা করে। এটি আমরা একটি পাঠ্য পড়ার আনুভূমিক চলন হিসাবে বিবেচনা করতে পারি। এ ছাড়াও, শব্দগুচ্ছটির একটি সংস্কৃত ঐতিহ্যগত মানবিন্দু (রেফারেন্স পয়েন্ট) রয়েছে। এ সম্পর্কে সচেতন পাঠকদের বোধগম্যতার আরেকটি অতিরিক্ত স্তর থাকবে। এক স্তরে এই বাক্যাংশ আখ্যান পরিস্থিতিকে স্পষ্ট করে এবং চরিত্রের দৃশ্যমানতাকে বাড়িয়ে তোলে এবং একইসাথে একটি স্তরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আরও একটি স্তর যুক্ত করে দৃশ্যমানতাকে জটিল করে তোলে। এটিকে আমরা একটি পাঠের উল্লম্ব চলন হিসেবে বিবেচনা করতে পারি।
“সমাধিস্থ যোগীসদৃশ,”– চরিত্রের বর্ণনায় আরেকটি সংযোজন। পূর্ববর্তী শব্দগুচ্ছের মতো এটিতেও আনুভূমিক এবং উল্লম্ব, উভয় আন্দোলনই বর্তমান। চরিত্র সম্পর্কে একটি অতিরিক্ত বিশেষণ এখানে যুক্ত করা হয়েছে যার মাধ্যমে লেখার আভ্যন্তরীণ আনুভূমিক চলন দেখতে পাওয়া যায়। সমাধির ধারণার আবাহনের মাধ্যমে উল্লম্ব চলনের প্রবর্তনের চেষ্টাও আমরা দেখতে পাই এখানে। এই শব্দটির দ্বারা কোনো একটি বিশেষ ছবির উদয় ঘটে না, কিন্তু যাঁরা সাংস্কৃতিক বিশ্বদৃষ্টি (ওয়ার্ল্ডভিউ)-র সঙ্গে পরিচিত, তাঁদের বোধের জগতে কিছু তরঙ্গের সৃষ্টি করে শব্দটি। এটি এমন এক উপাদান যা ব্যক্তিগত ব্যাখ্যার মাধ্যমে কল্পনা করা আবশ্যক। এ ছাড়াও, এটা লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে পূর্ববর্তী বাক্যাংশে, বিশেষণ চিত্রটি উপন্যাসে উপস্থিত চরিত্রকে (সীতারাম) স্পষ্টতর করছিল। এই বাক্যাংশে, উপমা ব্যবহারের মাধ্যমে, একটি ‘যোগী’ চরিত্র অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। একে একটি চরিত্র বলা কঠিন, কারণ মূল আখ্যানে এটি যে শুধু অনুপস্থিত, তাই-ই নয়, হয়তো অপ্রয়োজনীয়ও বটে। কিন্তু, এই ফিগার অব স্পিচটি আমাদের সামনে থাকা সীতারামের ছবিকে, অন্য আরেকটি দেহের কল্পনা দ্বারা ধারণ করে।
“কেবল মাত্র নিষ্পলক চক্ষুর্দ্বয় মহাকাশে নিবদ্ধ, স্থির;”– এটি একটি ক্লোজ আপ শটের মতো প্রায়। এর আগের কিছু বাক্যাংশে আমরা স্থান ও চরিত্র সম্পর্কে কিছু তথ্য পাচ্ছিলাম যা থেকে একটি বৃহৎ দৃশ্য আমাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছিল। যদি আমরা সিনেমার পরিভাষা ধার করি তবে বলা যেতে পারে, এর আগের বাক্যাংশগুলি লং শটের ন্যায় কাজ করছিল কিছুটা। কিন্তু এখানে লেখক আমাদের হঠাৎ করেই চরিত্রের দেহের খুব কাছে নিয়ে আসেন। এই লেখায় বর্তমান নানা জটিল অলিগলির উপরে, এই দ্রুত স্থানান্তরটি পাঠের মসৃণ প্রবাহে একটি বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। অন্যভাবে বলতে গেলে, পাঠকরা কিছুটা হলেও চরিত্র এবং স্থান থেকে কাল্পনিক চাক্ষুষ দৈর্ঘ্য এবং আনুভূমিক উল্লম্ব আন্দোলনে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও, দৃশ্যের এই হঠাৎ দূরত্ব পরিবর্তন তাদের পুনরায় আহ্বান করে নিজেদের দেখাকে অস্থিতিশীল করতে। তা ছাড়াও, এটা লক্ষ করা যেতে পারে যে, এখানে একটি ক্ষুদ্র বৃত্তাকার চলন রয়েছে। চোখ এবং আকাশের মধ্যে সম্পর্ক, প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষ আমাদের এই অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় বাক্যাংশে ফিরে যাওয়ার একটি উপায় হয়ে ওঠে যেখানে তাৎক্ষণিক, বর্তমান স্থানকে আহ্বান করা হয়েছিল।
“তিলেক চাঞ্চল্য নাই, প্রকৃতি নাই”– এখানে একটি কমা দ্বারা পৃথক করা দু-টি বিশেষণ চিত্র রয়েছে। তারা উভয়ই চোখের বর্ণনা করছে যা পূর্ববর্তী বাক্যাংশে প্রবর্তিত হয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রথম চিত্রটি আসলে এই অনুচ্ছেদের মধ্যে সবচেয়ে সহজ, এটি চোখের প্রায় একটি দৈনন্দিন উপস্থাপনা তৈরি করে। চোখের মণির স্থিরতা, যা হয়তো প্রায়শই চরম দুর্বলতা বা ক্লান্তির একটি খুব প্রচলিত এবং স্বাভাবিক মানবিক অবস্থা। সুতরাং, এই অভাব (স্থিরতা, চলনের অভাব) আমাদের এই মুহূর্তে চরিত্রের পরিস্থিতির কাছাকাছি নিয়ে যায়। পরের বাক্যাংশটি একটু জটিল। কমলকুমার মজুমদারের লেখায় এই ধরনের বাক্যাংশ প্রচুর আছে যেখানে শব্দগুলি মনের চোখে একটি চিত্র তৈরি করে, কিন্তু সেই চিত্র স্পষ্টভাবে প্রকাশ করার মতো যথেষ্ট নয়। উপন্যাসটি পড়ার পরে প্রত্যেক পাঠক লেখক কী বলতে চাইছেন তার একটা ধারণা পান, কিন্তু সেই ছবি অত্যন্ত ভঙ্গুর। যে মুহূর্তে উচ্চারণের অনুভূতি এটিকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করবে, এটি তক্ষুনি ভেঙে পড়বে। এইভাবে, কিছু মোড় তৈরি হয় যেখানে একটি ‘অন্য চিত্র’ জন্ম নেয়। চিত্র শুধুমাত্র এই শব্দগুচ্ছ দ্বারা নির্মিত হয় না। পুরু বর্ণনার (থিক ডেসক্রিপশন) পূর্ববর্তী স্তরগুলি (যা এর আগের বাক্যাংশগুলিতে উপস্থিত) একটি সহজবোধ্য চিত্রের (“তিলেক চাঞ্চল্য নাই”) দিকে আমাদের নিয়ে যায়। যার পরেই আমরা আবার খুঁজে পাই একটি অনন্য চিত্র (“প্রকৃতি নাই”) যা ইন্দ্রিয়ের নাগালের মধ্যে, তবুও স্পষ্টত প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট নয়।
“ক্রমাগতই বাঙ্‌ময়ী গঙ্গার জলছলাৎ (শ্রবণ চিত্রের স্পর্শমানতার একটি উল্লেখ, যা পাঠকদের তাদের বিভিন্ন সংবেদনশীল অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সচেতন হতে বাধ্য করে) তাঁহার বিশীর্ণ পদদ্বয়ে লাগিতেছিল।”– একটি সুনির্দিষ্ট বিবরণ আমাদের অনুচ্ছেদের শেষে নিয়ে আসে। উল্লেখ্য যে, এখানে একটি পোর্টম্যান্টো শব্দের (এমন একটি শব্দ যা নানা শব্দের অংশ জুড়ে তৈরি) কৌতূহলী ব্যবহার রয়েছে। জলছলাৎ– জল ও ছলাৎ দু-টি আলাদা শব্দ, যার প্রথমটি বিশেষ্য এবং দ্বিতীয়টি ধ্বনিবৃত্তি / অনুকার শব্দ যা ‘অনোম্যাটোপেইয়া’ (onomatopoeia) নামে পরিচিত। এদের একত্রীকরণে যে-শব্দ তৈরি হচ্ছে তাতে জল এবং ছলাৎ দুয়েরই অর্থ রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, একটি বিশেষ স্পর্শমানতা তৈরি হচ্ছে এখানে যা দু-টি প্রাথমিক শব্দকেই ছাড়িয়ে যায় এবং জলের তারল্য, তার স্পর্শের ভাব তৈরি করে। অনোম্যাটোপেইয়া হলো বিশেষ্যের প্রভাব। উভয়ের মধ্যে একটি তাৎক্ষণিক কার্যকারণ সম্পর্ক হয়তো অনুমেয়, যেহেতু জলের শব্দকেই সাধারণত ‘ছলাৎ’ দ্বারা প্রকাশ করা হয়ে থাকে। তবুও, তাদের একটি একক শব্দে একত্রিত করা একটি এমন দৃষ্টিকোণ তৈরি করে যা রৈখিক নয়।
কমলকুমার যা অর্জন করতে পেরেছিলেন তা অসাধারণ; তার পুরো প্রকল্পটিকে একজন চাক্ষিক কারিগরের সংবেদনশীল এক ইউরোপীয় রেনেসাঁ-দৃষ্টিভঙ্গির ভাষাগত সমালোচনা হিসাবে দেখা যেতে পারে, যেখানে ফ্রেম অনুপস্থিত, আলো ছায়া তৈরি করে না এবং ত্রি-মাত্রিক বিভ্রান্তিকর অনুকরণ বা মিমেসিস হয় না। বহু-দৃষ্টিকোণ দ্বি-মাত্রিক চাক্ষুষ নন্দনতত্ত্বকে প্রতিস্থাপিত করেছে। তিনি আসলে ইউরোপীয় রেনেসাঁ-দৃষ্টিকোণ প্রভাবিত শৈল্পিক সংবেদনশীলতার আধিপত্যবাদী সাধারণীকরণের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর বিকল্প প্রস্তাব করতে পেরেছেন।
উপরি-ধৃত পুরো বাক্যটিকে এখন নানা বাক্যখণ্ডের সমষ্টি (সিন্ট্যাকটিক আসেমব্লেজ়) হিসেবে ধরা যেতে পারে। এই খণ্ডগুলির নিজস্ব এক আভ্যন্তরীন প্রায়-স্পর্শমান দিক রয়েছে, অনেকটা খুঁজে পাওয়া প্রত্ন-কারুখণ্ডের মতো, যার বর্তমানতা-বিচ্যুতি এক অচেনা কল্পিত সময়ভাব দিয়ে পূর্ণ হওয়া সম্ভব।
এখানে আরেকটি উদাহরণের অবতারণা করা যেতে পারে, ভাষাগত আখ্যানভাবের কারুশিল্পগত দিকটিকে কাছ থেকে দেখার জন্য। এই অংশটি উপন্যাসের প্রায় মধ্যভাগ থেকে নেওয়া। যশোবতী ও সীতারাম গঙ্গাতীরে এখন একা। যশোবতী জানে তার সতী হওয়ার সম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গেই তার একরকম দেবী ও মানবী রূপের মধ্যবর্তী অবস্থানের কথা। তবু, তার মানবীমন সীতারামকে জিজ্ঞাসা করে, তার জন্য সীতারামের মায়া হয় কি না। তার উত্তরে সীতারামের “কনে বউ” ডাক এবং সেই ডাকের মর্মনির্মাণ।
এ স্বর মধুর হইলেও ক্ষেত্র-দাহের বীভৎস নিষ্ঠুর আওয়াজের বিকার ছিল। এই ডাকে গোলাপের শোভা নষ্ট হইল; যেন কাব্য প্রলয়ে সমাচ্ছন্ন হইয়াছে, যেন চিত্র-সংজ্ঞা ধূলাদষ্ট হইয়াছে, যেন মহতী কীর্ত্তি অবসন্না হইয়াছে, যেন শ্রদ্ধা অপমানিতা, প্রজ্ঞা ক্ষীণ, যেন দেবস্থান বিধ্বস্ত হইয়াছে, নদী স্বল্পতোয়া, বেদ-ব্রাহ্মণ ধূসরিত হইয়াছে। (অন্তর্জলী যাত্রা, পৃ ৪৭)
সীতারামের যশোবতীর প্রতি যে মায়া, সে মায়ায় হয়তো এক বিতৃষ্ণা রয়েছে, তবু এই বহু বাক্যখণ্ড সংবলিত অংশে যেভাবে ক্রমাগত নানা ভাবের উদয় হয়, যেভাবে কিছু ছবি তৈরি হতে হতেও মিলিয়ে যায়, যেভাবে মানে ও অর্থপ্রকাশের বাইরেও এক অনুভূতির জগৎ উপস্থাপিত হয়, তা কি কোনো শিল্পবস্তুকে ছুঁয়ে দেখার যে দৈহিক বিদেহী অভিব্যক্তি, তার চেয়ে খুব আলাদা? লক্ষণীয় যে, মূল অর্থকে সবিশেষভাবে উল্লেখ করার উদ্দেশ্যে রূপকের (মেটাফোর) ব্যবহার করা হয়নি। রূপক যেভাবে দু-টি বস্তুর মাঝে এক কল্পিত ছবির সেতু ব্যবহার করে, তা হয়তো রেনেসাঁ পদ্ধতি থেকে খুব দূরে অবস্থিত নয়। এখানে আমরা দেখি ছবির একে অন্যের উপর উপস্থাপনায় অনুরূপক বা উপমার (সিমিলি) ব্যবহার। এই ব্যবহারে প্রতিটি ছবির যে নিজস্ব অর্থ ও ভাবজগৎ আছে তা ফুটে ওঠে। এই ছবিগুলি কেবল এই উপন্যাসে প্রয়োজনীয় অর্থবিন্যাসের জন্য তৈরি নয়। এদের পৃথক অবস্থান আছে। এরা এখানে একত্রিত হয় একটি বিশেষ ভাববন্ধ তৈরির উদ্দেশ্যে। ছবির এই নিজস্ব জগৎ ও প্রসঙ্গনির্ভর (কনটেক্সচুয়াল) জগৎ, এই দুইয়ের যোগসাধন ঘটে উপমা ব্যবহারে। এখান থেকে আরও একটি সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে। তা হলো, একটি ছবিতে ‘পৌঁছোনো’র চেষ্টায় জোর দেওয়া। এবং এখানে কমলকুমারের সাহিত্যের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান ফুটে ওঠে। প্লেটোর মতের বিপরীতে কমলকুমার একটি ছবি তৈরিতে সন্তুষ্ট নন। এই নানা ভাবময় বাক্যাংশের স্তূপীকৃত ভাষাস্থাপত্যে কমলকুমার পৌঁছাতে চেষ্টা করছেন একটি ছবির বোধে। বাক্যগঠনের গাণিতিক মতে (সিনট্যাক্স অনুযায়ী) তৈরি একটি নির্দিষ্ট দৃশ্যমানতা সংবলিত ছবি নয়, কমলকুমার ‘পৌঁছাতে’ চান একটি ছবির ধারণায়। এই ধারণায় দু-জন মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা ছবিরা কখনোই এক হবে না। এমনকী নানা সময়ের তফাতে একজন পাঠকের পাঠের মধ্যেও তৈরি হবে নানা ফারাক। কাজেই এই উদ্ভাসসম্ভাবনাময় ছবির অবতারণা ইউরোপীয় রেনেসাঁ দৃষ্টিকোণের বিপরীতে একটি ছবির ধারণার প্রতি ইঙ্গিত করে, যে-ছবি তৈরি হওয়া কখনোই শেষ হয় না।
গৌতম ঘোষ (১৯৫০-), বাংলার একজন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা, তাঁর গুরুত্ব কেবল তাঁর সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত চলচ্চিত্রের তালিকাতেই নিবদ্ধ নয়, নিবদ্ধ নয় বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত চলচ্চিত্রগুলি দ্বারাই, বরং তাঁর একটি নিজস্ব ও আকর্ষণীয় চলচ্চিত্রের গতিপথের ধারাবাহিকতায়। তাঁর চলচ্চিত্র তৈরির পদ্ধতি বুঝতে হলে আমাদেরকে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।
সত্যজিৎ রায়ের অনন্য চলচ্চিত্র ভাষার উত্থান বাংলার তথা ভারতের চলচ্চিত্র জগতে একটি লিরিক্যাল-রোমান্টিক-বাস্তববাদকে উদার মানবতাবাদের সাথে সম্পর্কিত করে, যেখানে সাংস্কৃতিক পটভূমির নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের এক অসম্ভব গুরুত্ব রয়েছে। বাংলা চলচ্চিত্রে এটি এক বিশেষ গতিশীলতার প্রবর্তন করেছিল, যার প্রভাবে বাংলার সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সামাজিক বাস্তবতাকে অনেক চলচ্চিত্রনির্মাতা তাঁদের কাজের মাধ্যমে অধ্যয়ন করতে শুরু করেন। এখানে এটা পরিষ্কার করা দরকার যে, এই কথা উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে এইসব পরবর্তী চলচ্চিত্রনির্মাতারা সত্যজিৎ রায়কে অনুকরণ করেছিলেন, এমন দাবি কিন্তু জানাচ্ছি না আমরা। বরং বলতে চাইছি, সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের অন্বেষণ এবং ব্যাখ্যা দ্বারা বাংলার সাংস্কৃতিক ও ভূ-সামাজিক স্থানটির যে একটি সমৃদ্ধি বা বিকাশ ঘটেছিল যা পরবর্তীতে অন্যান্য কিছু উপাদানের অন্বেষণের পথ খুলে দিয়েছিল। গৌতম ঘোষ এই শেষোক্ত চলচ্চিত্রনির্মাতাদের একজন যিনি সমাজের এমন কিছু উপাদান অন্বেষণে আগ্রহী হয়েছিলেন যেগুলি একটি দুর্বল এবং বিচ্ছিন্ন সমাজের বিবর্তন চিহ্নিত করে। জাতিভেদ প্রথা, সতীদাহ এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজের লিঙ্গ অসাম্য– এইসব মোটিফ তাঁর চলচ্চিত্রে ফিরে ফিরে আসে। তাঁর তীক্ষ্ণ এবং সূক্ষ্ম উপস্থাপনার মাধ্যমে তিনি এমনসব প্রথার বিরুদ্ধে জোরালো রাজনৈতিক বক্তব্য উপস্থিত করেন ও তার ভিতর দিয়ে মানুষের বেদনা ও নিপীড়নের চিহ্নগুলি প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। তাঁর প্রামাণ্যচিত্রের (ডকুমেন্টারি) পটভূমি তাৎক্ষণিক বাস্তবতার একটি নির্দিষ্ট অনুভূতি গোটা চলচ্চিত্রের মধ্যে গেঁথে তোলে। যার ফলে যা প্রত্যক্ষ তা তাঁর চলচ্চিত্রে একটি শক্তিশালী গতিশীলতা খুঁজে পায়। অন্তর্জলী যাত্রা এর থেকে আলাদা নয়। এই ছবিটি যে-সময়ে নির্মিত, সেই সময়টি লক্ষ করা দরকার। ১৯৭৯ সালে কমলকুমারের মৃত্যুর এক দশকের কম সময় পরে (১৯৮৭) ও উপন্যাসটি প্রকাশিত (১৯৬৯) হওয়ার প্রায় দুই দশক পরে এই চলচ্চিত্র তৈরি হয়। সেই সময় সমগ্র ভারত রূপ কানওয়ারের সতী হওয়ার ঘটনা নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছিল। ওইরকম একটি অস্থির সময়ে এই উপন্যাসটির চয়নও এক বিশেষ ঘটনা। চলচ্চিত্রটিকে উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে এই সময়ের নিরিখে এক ধরনের পুনঃপঠন হিসাবে অধ্যয়ন করা যেতে পারে। চলচ্চিত্র এবং উপন্যাসের অবস্থান একে অপরের থেকে অনেক আলাদা। যেখানে উপন্যাসটির কেন্দ্রবিন্দু হলো কারুজগতের বস্তুগত ভাষা (মেটিরিয়াল ল্যাংগুয়েজ)-র মাধ্যমে জগতের বস্তুগত ভাষা অন্বেষণ করা, একটি শৈল্পিক জ্ঞানতত্ত্ব অন্বেষণ করা। সেখানে চলচ্চিত্রটি জ্যামিতিক আলোকবিদ্যার (যা ইউরোপীয় রেনেসাঁ পরিপ্রেক্ষিতের মূল নীতি দ্বারা পরিচালিত হয়) উপর ভিত্তি করে ক্যামেরার চিত্রনির্মাণ প্রক্রিয়ার সাহায্যে সতীদাহের ধারণাটি এবং তার সামাজিক নিহিতার্থ, বিশেষত ঋণাত্মক দিকটিকে পুনঃপ্রাসঙ্গিক করার প্রচেষ্টা করে। উপন্যাসটি আমাদের চারপাশের জগৎ থেকে নানা চিত্র ও চিত্রধারণা সংগ্রহ করে। এবং এই সূত্রে তাদের নানা কারুবোধের উপস্থাপনার কাজে ব্যবহার করে। কাজেই একদিকে যেমন সংগৃহীত জগতের উপস্থাপনা ঘটে তেমনই অন্যদিকে এমন একটি শিল্পজগতের উপস্থাপনাও ঘটে যা আমাদের চারপাশে খুব সহজে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। হয়তো এভাবেই উপস্থাপনার একটি মেটা-আখ্যান তৈরি হয়। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে, উপন্যাসের মূল চিত্রগুলির পরদায় কাল্পনিক রূপান্তর ঘটে। উপন্যাসই চলচ্চিত্রের ভিত্তি। উপন্যাসটির বক্তব্যের এক ধরনের প্রতিনিধিত্ব করার চেষ্টা করে চলচ্চিত্রটি। চলচ্চিত্রনির্মাণের নৈপুণ্যের একটি নির্দিষ্ট আদর্শের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চিত্রগুলির পুনর্বিন্যাসের দিকে কোনো বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয় না এখানে। অন্যভাবে বলতে গেলে, উপন্যাসের বিষয়বস্তু চলচ্চিত্রনির্মাতা দ্বারা অনুবাদিত হয়ে পরদায় একটি উপস্থাপনা খুঁজে পায়, যা গৌতম ঘোষের বৃহত্তর কর্মজীবনেরই এক ধরনের প্রতিফলন। ঔপন্যাসিক এবং চলচ্চিত্রনির্মাতার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এই পার্থক্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এ থেকে দেখা যেতে পারে কীভাবে এই দু-টি অভিযোজন দু-টি ভিন্ন ধরনের চিত্রচেতনাকে সংজ্ঞায়িত করছে।
গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক তাঁর ‘অ্যাক্টিং বিটস / আইডেন্টিটি টক্’ (স্পিভাক ১৯৯২) লেখাটিতে উল্লেখ করেন কীভাবে কমলকুমার ও গৌতম ঘোষের পথ উপন্যাসের শুরু থেকেই আলাদা হয়ে যাচ্ছে। কমলকুমার, স্পিভাক-এর মতে, অন্যান্য নিষ্ঠার সাথে এমন একটি বিশ্বাসের জগৎ তৈরি করেন যা আমাদের জগৎ থেকে অত্যন্তই দূরবর্তী। এর কারণ এই নয় যে, কমলকুমার নিজের ইচ্ছায় একটি দূরত্ব তৈরি করতে চান। বরং তিনি আসলে এক নিকটবর্তীতাকেই সামনে আনতে চান। পরিপ্রেক্ষিতগত আদর্শ (পার্সপেক্টিভাল নরম্যাটিভ)-কে প্রশ্নের সামনে আনার জন্যে তিনি উপন্যাসের তিনটি চরিত্রকে “স্বাভাবিক” বা “আদর্শ” হিসাবে দেখাতে উৎসুক নন। “স্বাভাবিক” বা নর্মাল থেকে সবথেকে দূরবর্তী তিনটি চরিত্রকে সামনে এনে তিনি আইডেন্টিটির স্বাভাবিকত্বকে পরিমাপ করেন। স্পিভাক-এর মতে, এইভাবে কমলকুমার আমাদের সকলের আইডেন্টিটিকে এই জগতের পরিমাপের স্কেলে আনেন। প্রসঙ্গত, জন পি লিভি এবং রিচার্ড র‍্যান্ড -কৃত দেরিদা-র অনুবাদ থেকে উদ্ধৃত করে বলি: ‘একটি আধান বা আফেক্ট (affect)-কে কীভাবে একটি বিশেষ অঙ্গুষ্ঠছাপ দেওয়া যেতে পারে?’ স্পিভাক-এর মতানুযায়ী কমলকুমার সেই চেষ্টাই করেছেন।
অন্য দিকে গৌতম ঘোষের নির্মিত চলচ্চিত্রটি একটি বিশেষ রাজনৈতিক আবহের পটভূমিকায় তৈরি। রূপ কানওয়ার-এর সতী হওয়ার পরে ভারতে যে ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় এবং যার ভিত্তিতে সতীদাহ প্রতিরোধ আইন কমিশন তৈরি হয়, তার ঠিক পরে পরেই তৈরি এই চলচ্চিত্রের পক্ষে ওই তিনটি চরিত্র এবং বিশেষত যশোবতীর ব্যক্তিসত্তার নানা সূক্ষ্ম দিকের পরিচয় দেওয়া হয়তো সম্ভবও ছিল না। কিন্তু চলচ্চিত্রের ব্যাপ্তি তাঁর শিল্পসম্ভাবনাকে কেবলমাত্র প্রয়োজন ও সামাজিক আবেদনের সংকীর্ণ সীমার মধ্যে থাকতে দেয় না। হয়তো এই কারণেই স্পিভাক চলচ্চিত্রটি থেকে পাঁচটি লুক তুলে ধরেন, যার মাধ্যমে হয়তো আমরা অনুমান করতে পারি চলচ্চিত্রকারের ভাবনার অন্যতর সম্ভাবনার কথা:
১. বিবাহ প্রথার নামাঙ্কনরূপে মালাবদল হওয়ার আগে যশোবতীর কুমারী লুক;
২. শরীরী অন্বেষণের পুনরাবৃত্তির আশায় যশোবতীর মন্দিরের অদ্ভুতদর্শন দেবীর দিকে তাকানো;
৩. পূর্ববর্তী সতীর হাতের অনুকরণে অঙ্কিত সতী স্মারক;
৪. চলচ্চিত্রটির শেষদিকে পরিত্যক্ত প্রতিমা কাঠামোয় আটকে থাকা যশোবতীর দেহ যা বিসর্জনের স্মৃতি জাগরিত করে;
৫. নৌকায় অঙ্কিত চোখ যার দৃষ্টি নেই।
এতদ্‌সত্ত্বেও এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, নামভুমিকা থেকেই পরিচালক আমাদের সতর্ক করে দিচ্ছেন যে বেন্টিঙ্ক-রামমোহনের ঐতিহাসিক পদক্ষেপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই চলচ্চিত্রটি কমলকুমারের উপন্যাসাশ্রয়ী আখ্যানের একটি সামাজিক পাঠ, যা কিনা কমলকুমারের নিজস্ব শিল্পপ্রশ্ন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
এর অন্যদিকে এবার এমন কিছু উদাহরণ দেওয়া প্রয়োজন যেখানে চলচ্চিত্রটিতে কমলকুমারের আখ্যান-কলার একটি প্রসারণ ঘটানোর সুনির্দিষ্ট চেষ্টা রয়েছে। গৌতম ঘোষের প্রায় সমসাময়িক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (১৯৪৪-২০২১) বাংলা এবং ভারতের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চিত্রপরিচালক। সমসাময়িকতার কারণে তাঁদের কর্মক্ষত্রে কিছু মিল থাকলেও বুদ্ধদেব বাংলায় চলচ্চিত্রের ভাষা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করেছেন যা অন্য চিত্রপরিচালকদের ক্ষেত্রে সেভাবে দেখা যায়নি। চিত্রচেতনার নানা স্তর নিয়ে কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্রের বেশ কিছু প্রায়োগিক বিশিষ্টতাকে তিনি ধারণাগতভাবে অন্বেষণ করেছেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য হলো তাঁর লং টেক, ডেপ্‌থ ও ক্যামেরার চলনের বিন্যাস পরিকল্পনা, এবং চলচ্চিত্রের কাহিনির বাইরে চলচ্চিত্রের গঠনশৈলীর (ফর্ম) উপর জোর দেওয়া ইত্যাদি। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত কমলকুমার মজুমদারের দু-টি ছোটো গল্পের উপর চলচ্চিত্র প্রস্তুত করেছেন– নিম অন্নপূর্ণা ও তাহাদের কথা। আমরা আমাদের আলোচনায় এখানে মূলত তাহাদের কথা নিয়ে কিছু প্রসং উত্থাপন করতে চাইছি।
তাহাদের কথা তৈরি করতে গিয়ে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন, যা তাঁর গভীর শিল্পবোধের পরিচায়ক। প্রথমত, যে-ছোটোগল্প নিয়ে কাজ করেছেন তিনি সেটি তাঁর সমসাময়িক কোনো সামাজিক বৃত্তান্তের পটভূমিকায় অবস্থিত নয়। ফলে, সামাজিক বা রাজনৈতিক কোনো আকাঙ্ক্ষার ভিতের ওপর চলচ্চিত্রটি দাঁড়িয়ে নেই। দ্বিতীয়ত, ইমেজ ও দৃশ্য গঠনের মাধ্যমে তিনি যে আখ্যানের তুলনায় চলচ্চিত্রের গঠনশৈলীর দিকে তাঁর অধিক উৎসাহকে সংহত করতে চেয়েছেন তা ছবিটিতে স্পষ্ট করে দেন। তৃতীয়ত, তাঁর কাজটি একটি ছোটোগল্প নিয়ে। কমলকুমারের অত্যন্ত জটিল সাহিত্যিক গঠনের পরিচয় তুলে ধরতে গেলে যে সময়ব্যাপ্তির প্রয়োজন তারজন্য হাতের দেড়-দু’ঘণ্টা সময় যথেষ্ট নয়। কাজেই, ছোটোগল্প চয়নের মধ্য দিয়ে তিনি সেই পরিসর পেয়ে যান যার দ্বারা কিছুটা হলেও দর্শকদের কাছে আখ্যানগঠনের পরিচয়টিকে তুলে ধরা সম্ভব। তাঁর কাজে প্রথমেই যা চোখে পড়ে তা হলো এই যে, তিনি কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতির অবতারণা করেন যাদের কার্যকরণগত গুরুত্বের বাইরে অন্য দিকও আছে। সেসব একভাবে চলচ্চিত্রের ভাষার প্রকাশ ঘটায়। তাঁর এই সিনে-সিনট্যাক্সের কয়েকটি দিক এখানে বর্ণনা করা যাক।
১. প্রথমত তাঁর শটের দৈর্ঘ্য। যা চোখে পড়ার মতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত সুকল্পিতভাবে লং টেক নিয়ে কাজ করেছেন। তিন থেকে চার মিনিটের শট এই চলচ্চিত্রটিতে নিতান্ত কম নয়। লং টেকের মাধ্যমে সময়ের ধারণা নিয়ে তাই বেশ কিছু দৃশ্য আমরা চিত্রায়িত হতে দেখি। কেবলমাত্র শটের স্থায়িত্বকাল নয়, শটের মধ্যে যে-সময়কে দেখানো হচ্ছে তাকে তিনি একভাবে বাড়িয়ে নিতে পেরেছেন। এ ছাড়াও, শটের মধ্যে নানা ধরনের ডেপ্‌থ (মূলত দরজা ও জানালার চরিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ অবস্থানের মাধ্যমে। লক্ষণীয় যে তিনি প্রায় কখনোই জানালায় গরাদ বা দরজার অংশকে দেখাননি। এর দরুন আমাদের, দর্শকদের দৃষ্টি বাধাহীনভাবে এদেরকে নানা গভীরতার স্থানক বা ডেপ্‌থ মার্কার হিসাবে দেখতে পেরেছে, ক্যামেরা ও চরিত্রের চলনের মাধ্যমে দৃশ্যবিন্যাস ইত্যাদি দ্বারা তিনি আমাদের সামনে ঘটিত ঘটনা থেকে বাইরে এনে আমাদের ছবির গঠনের সঙ্গে একভাবে পরিচয় করিয়েছেন। বিশেষভাবে বলব, ডেপুটিসাহেবের সঙ্গে দেখা সেরে ফেরার সময় শিবনাথ যখন বিপিনের সঙ্গে কথাকাটাকাটি করে, তখন হঠাৎ প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়। তাঁর আগে থেকেই শটটিতে বেশ কিছু উত্তেজক ঘটনা ঘটছিল, ফলে দর্শকরা শটটির অস্থিরতার সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করেছিলেন, তখন হঠাৎ এই সশব্দ বৃষ্টির অবতারণা, যা চরিত্রদের কথা ও দৃশ্যমানতাকে ঢেকে দেয়, আড়াল করে, যা আমাদের মধ্যে একপ্রকার বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। কমলকুমারের গঠনশৈলীতে আমরা দেখেছি পাঠকদের কখনোই তিনি কোনো এক চিত্রকল্পে স্থির হাতে দেন না, এখানে তারই কি একটা প্রতিফলন চোখে পড়ে না?
২. কোনো শটে যখন বিস্তৃত স্থানের সঙ্গে দর্শকদের পরিচিত করানো হয়, তখন গতিময়তা বা ডাইনামাজ়াইশনের মাধ্যমে তাঁর নানা অংশকে উজ্জীবিত করা হয়ে থাকে। রেনেসাঁ-প্রভাবিত দেখার ধরনের কারণে দর্শকদের ফ্রেমের কিছু বিশেষ স্থান উজ্জীবিত হতে দেখার একটি অন্তর্নিহিত চাহিদা তৈরি হয়। যেমন, ফ্রেমের মধ্যভাগ, বা পুরোভাগে দর্শকদের দৃষ্টির মূল একাগ্রতা নিবদ্ধ হয়ে থাকে। এখানে পরিচালক সেই স্থানগুলির পরিবর্তে, এবং রেনেসাঁ-প্রভাবিত আমাদের দৃষ্টি-আকাঙ্ক্ষার কিছুটা বিপরীতে ফ্রেমের দূরবর্তী এবং অপ্রত্যাশিত কিছু অংশকে ডাইনামাইজ় করেন।
৩. কমলকুমারের ধরনে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তও শটের মধ্যে এক ধরনের আনুভূমিক ও উল্লম্ব চলনের (ক্যামেরার চলনের থেকে আলাদা) প্রয়োগ ঘটান যেখানে শটের নিজস্ব সম্মুখগতি ছাড়াও তার মধ্যে ব্যবহৃত কিছু বস্তুর মাধ্যমে একটি অন্য গতি তৈরি হয়। আয়না ও তাঁর নানারকম প্রতিফলন, যার হয়তো কিছু বাস্তব কারণ দেওয়া হয়, কিন্তু তাঁর প্রকাশ ও উদ্ভাস সেই কারণকে ছাপিয়ে যায় বহুগুণে। এর মাধ্যমে আরও একটি ঘটনা ঘটে, আমাদের দেখার যে স্বাচ্ছন্দ্য তার ক্ষণভঙ্গুরতা সামনে আসে। আমরা যা দেখছি তা এক ধরনের “রিপ্রেজ়েন্টেশন”– এই ধারণাটি নিম্নরেখচিহ্নিত হয়।
এই তালিকা অবশ্যই সামগ্রিক নয়। কিন্তু এক সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা থেকে আমরা দেখতে পারি কীভাবে কমলকুমার এবং পরবর্তী কিছু শিল্পীদের হাতে একটি সুনির্দিষ্ট পথ চিহ্নিত হয়েছে যা আমাদের কলোনিয়ালিটি প্রণোদিত রেনেসাঁ দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে অন্যভাবে ছবির ধারণাকে দেখতে সাহায্য করতে পারে। এই চিত্রধারণা কারুশিল্পের ধাঁচ থেকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত এবং শুধু ‘দেখা’ ছাড়াও অন্যভাবে জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকে (যেমন স্পর্শ দ্বারা) যথোচিত গুরুত্ব প্রদান করে। তাহলে কি এই চিত্রধারণাটি একভাবে আমাদের নিজস্ব ডিকলোনিয়াল খোঁজ হয়ে উঠতে পারে না? যেখানে আমরা আমাদের বোধের সংস্কৃতি দ্বারা কলোনিয়াল-মডার্ন ধাঁচের ন্যায্যতা প্রকরণের চেষ্টা না করে বরং তার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে আমাদের সামনে কি কি সম্ভাবনা ফুটে উঠতে পারে তার চেষ্টা করি।
শেষ করার আগে কমলকুমারের আরেকটি অবদানের কথা না বললেই নয়। আমরা শুরুতে ভাজ়কুয়েজ়-এর শ্রবণতত্ত্ব নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছিলাম। কমলকুমারের যাত্রা সেই শোনা-বলা-ভাবার নিটোল ত্রিভুজে নৈঃশব্দ্যের একটি নতুন দিক যুক্ত করেছে। পাঠ ও দেখার মাঝে এই যে দূরত্ব, এতে কি একপ্রকার নৈঃশব্দ্যের আভাস নেই ? এই নৈঃশব্দ্য অসহায় নয়, বরং বাঙ্‌ময়। এই অদৃশ্য নৈঃশব্দ্যের এক শক্তি আছে, যার প্রদর্শনের আভাস পাওয়া যায়, যখন তাঁর মধ্যে প্রবেশের পথ সহজ ও সাবলীল না-হয়ে হয়ে ওঠে দুরূহ। হয়তো এই বিশেষ চিত্রধারণা এবং এই বিশেষ নৈঃশব্দ্য একই মুদ্রার দুই পিঠ হয়ে ওঠে।

গ্রন্থপঞ্জি

মজুমদার, কমলকুমার। “অন্তর্জলী যাত্রা”, উপন্যাস সমগ্র, কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১১।

মজুমদার, কমলকুমার। “সুহাসিনীর পমেটম”, উপন্যাস সমগ্র, কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১১।

Márquez, Gabriel García. “The Solitude of Latin America”. Nobel Lecture. Dec 1982. https://www.nobelprize.org/prizes/literature/1982/marquez/lecture/

Morton, Stephen. “The Subaltern: Genealogy of a Concept”, in Gayatri Spivak: Ethics, Subalternity and the Critique of Postcolonial Reason. Malden, MA: Polity, 2007: pp. 96-97

Hoare, Quintin, and Geoffrey Nowell-Smith. “Terminology”, in Selections from the Prison Notebooks. New York: International Publishers, pp. xiii-xiv

Rolando Vazquez (2017): Precedence, Earth and the Anthropocene: Decolonizing Design, Design Philosophy Papers, DOI: 10.1080/14487136.2017.1303130

Rolando Vazquez, ‘Decolonial listening: An interview with Rolando Vàsquez.’ 2018-19. https://www.soapboxjournal.net/print-editions/1-1-practices-of-listening.

Deleuze, Gilles. “The Movement Image and its Three Varieties.” In Cinema 1: The Movement-Image. Trans. H. Tomlinson and B. Habberjam. Minneapolis: U of Minnesota Press, 1986-89. pp. 91-104.

Smith, Pamela. The Body of the Artisan: Art & Experience in Scientific Revolution. Chicago: University of Chicago Press. 2004.

Ganguly, Debkamal. Wood-cut like Urban Evening: Kamalkumar and Paradzanov’s Construction of Discourse on Visuality. Presented at International Bengal Studies Congress, 2011.

Spivak, Gayatri Chakravorty. “Acting Bits/Identity Talk.” Critical Inquiry 18, no. 4 (1992): 770–803. http://www.jstor.org/stable/1343830.

One Thought on কারুচিত্রের খোঁজে: কমলকুমার ও বঙ্গীয় চিত্রধারণা / সংস্কৃতি চট্টোপাধ্যায়

  1. Üsküdar 7/24 su tesisatçısı Üsküdar su kaçağı tespiti için profesyonel destek! Su sızıntılarını termal kameralarla kırmadan noktasal olarak buluyoruz. https://www.nextvio.net/read-blog/17249

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

হোয়াটসঅ্যাপের যুগে ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ / দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

October 8, 2024

One Thought on কারুচিত্রের খোঁজে: কমলকুমার ও বঙ্গীয় চিত্রধারণা / সংস্কৃতি চট্টোপাধ্যায়

  1. Üsküdar 7/24 su tesisatçısı Üsküdar su kaçağı tespiti için profesyonel destek! Su sızıntılarını termal kameralarla kırmadan noktasal olarak buluyoruz. https://www.nextvio.net/read-blog/17249

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *